হুমায়রা জিনাতঃ
শৈশবের অবারিত প্রান্তরে ছুটে বেড়াতাম তখন। বয়স ছিলো পাঁচ বছর। বাবা-মায়ের একমাত্র খুকুমণি ছিলাম।
ইবাদাতের বসন্ত ফুরিয়ে খুশির আমেজ নিয়ে এলো ঈদ। গোধূলি বেলার রক্তিম আভা নিভু নিভু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আঁধারে। আজকের সূর্যাস্ত আনন্দের বার্তা জানান দিয়ে প্রস্থান হচ্ছে। ইফতার করতে বসে শরবতটুকু পান করে ঈদের চাঁদ দেখতে ছুটে গেলাম রাস্তার মোড়ে।নিবিড় আনন্দোচ্ছসে মেতে উঠলাম ঈদ ঈদ রবে। বান্ধবীরা মিলে মেহেদি লাগানোয় ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। মধুর দুষ্টুমিতে প্রলিপ্ত সবাই।
এত হৈহুল্লোড় দুষ্টুমির মাঝেও ঈদের রাত্রিটা আমার কাছে বিষন্ন লাগছে। কারণ আব্বু এখনও ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরেনি। আমার ঈদের জামা আনা হয়নি। সন্ধ্যায় শুনেছি বাবা ঢাকা থেকে রওনা হয়েছে। তাই বিষন্নতার ফাঁকে ফাঁকে কিঞ্চিৎ স্বস্তি আর আনন্দ অনুভূত হচ্ছিলো। রাত এগারটায় আব্বু বাড়ি ফিরলেন বিশাল ব্যাগ হাতে নিয়ে।খুশিতে আব্বুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আহ্লাদী সুরে বলতে লাগলাম
-আব্বু আব্বু! আমার ঈদের ড্রেস কোথায়?
আব্বু বললো- তোমার জন্যে জামা আনিনি! সাথে সাথে মন খারাপ হয়ে গেলো। আমোদপ্রমোদ আশা-প্রত্যাশা সব মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। তবুও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে রাখলাম।আব্বু ঐ ব্যাগটি হাতে নিয়ে ফ্লোরে মাদুর বিছিয়ে ঘরের অন্য সদস্যদের হাতে ঈদের ড্রেস তুলে দিচ্ছে। সমবয়সী সবার হাতে নতুন জামা। ওরা আমায় মুখ বাঁকিয়ে বলছে; এবার তোমার জন্যে ঈদের জামা আনেনি। আামাদের জন্য এনেছে..কি মজা! কি মজা!
চুপটি করে বসে আছি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। ওদের মুখ বাঁকানি আর সহ্য করতে পারছিলামনা। কাঁদো কাঁদো অবস্থা হয়ে গেছে। কেঁদেই দিচ্ছিলাম প্রায়! এমন সময় আব্বু চিৎকার করে বলে উঠলো এইটা আমার লক্ষী মেয়ের জামা। সবার চেয়ে ভিন্নতর। দেখো আম্মু! তোমার জন্য পিংক কালারের জিন্স এনেছি। তোমাকে বেশ মানাবে।সর্বপ্রথম আব্বু তোমার জন্যই কিনেছি। আমি খুশিতে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলাম। জামাটা হাতে নিয়ে পেছনে গুঁজিয়ে ফেললাম। ছোটোবেলায় মনে করতাম ঈদের জামা কাউকে দেখালে আমার ঈদ চলে যাবে বুঝি।
ঈদের দিন খুব ভোরে ভোরে উঠলাম। আব্বুর সাথে উঠোন-ঘর পরিষ্কারের কাজে নেমে পড়লাম। তারপর একইসাথে গোসল সেরে নিলাম। জামা পড়ে সুগন্ধি মেখে আব্বুর আঙুল ধরে ঈদগাহে রওয়ানা দিলাম। আব্বুও আমাকে নিয়ে চললো। ঈদগাহে গিয়ে স্টেজে উঠে আব্বুর সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষের কাণ্ডকীর্তি দেখছি। আব্বু ঈদের খুৎবা দিচ্ছেন। বয়ান করতেছিলো। আমাকে লোকেরা ঈদি দিচ্ছে নতুন কচকচে নোট আব্বুর পাশের আলেম-ওলামারা সবাই আমার হাতে কচকচে নোট দিয়ে পুরিয়ে ফেলতেছে। আমিও খুশিমনে নিয়ে জিন্সের পকেটে পুরাচ্ছিলাম।
তারপর ঈদের নামাজ পড়াচ্ছে আব্বু। আমি পাশে বসে আছি। নামাজ শেষ হওয়ার পর দুইটা ছেলে রুমাল ধরে সবার থেকে টাকা উঠাচ্ছিলো। ডানদিক থেকে শুরু করে আমাদের দিকে আসছে। আমি আব্বুর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দশ-বিশ টাকার নোট কয়েকটা বের করে নিলাম। ছেলেগুলো আসলে দিবো বলে.. কারণ! আমি ভাবতাম ছেলেগুলো টাকা নিতে নিতে একদম শেষ কাতারে গিয়ে যখন ফের সামনে আসবে তখন টাকা ফেরত দিয়ে দিবে। তখন কত্তগুলো টাকা নিতে পারবো! মুঠো পুরে। তাই খুশিমনে বসে আছি..
অবশেষে ছেলেগুলা আমার সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আমি তাদেরকে ডেকে দাঁড় করালাম। বললাম এইযে! আপনারা আমার টাকা না দিয়ে চলে যাচ্ছেন যে? এই বলে রুমালের ভেতর দুহাত ঢুকিয়ে দিয়ে মুঠো পুরো টাকা নিয়ে নিলাম। ছেলেগুলা আমাকে কিছুই বলেনি। তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছিলো। কিন্তু আমি বুঝিনি ওরা কেন হাসছিলো..
আহ! শৈশবের সোনালী দিনগুলো আজ অতীত হয়ে গেছে। চাইলেও ফিরে পাবোনা সেই কনকময় প্রভাতগুলো। এখন আর আব্বুর সাথে ঈদগাহে যাওয়ার বায়না ধরিনা। তবুও এখনও ছোটোবেলার চঞ্চলা স্বভাব রয়ে গেছে।
এখন ঈদের দিন আব্বুর পান্জাবী, পাগড়ী, আতর আমাকে চুজ করে দিতে হয়। ঈদের রাতে তাফসীর, হাদীস, খুৎবা সংক্রান্ত বই আমি বের করে দেই। এতেই আমি ঈদের আনন্দ অমৃত স্বাদ উপভোগ করি।
আলহামদুলিল্লাহ..
Leave a Reply